এরপর থেকে পেরিয়ে গেছে তিনটি বছর। এসব রোহিঙ্গা বসতির কারণে ছয় হাজার একর বন ধ্বংস হয়েছে। তাদের জ্বালানি কাঠ হিসেবে ছাই হয়ে গিয়েছে আরও এক হাজার ৮৩৭ একর বন। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৫৫৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ধ্বংস হয়েছে প্রায় আট হাজার একর বনভূমি বা দুই হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এক হাজার ৮২৯ কোটি টাকার জীববৈচিত্র্য এবং ৫৯১ কোটি টাকার বনজদ্রব্যের ক্ষয়ক্ষতিও এই ধ্বংসলীলার অন্তর্ভুক্ত।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে গত অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে ক্ষয়ক্ষতিসংক্রান্ত এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। তখনকার পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংসদীয় কমিটি উখিয়ার কুতুপালংয়ে বনের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছিল।
কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বসতি এবং তাদের কারণে বনের যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার একটি চিত্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে; যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
রোহিঙ্গারা বনভূমিতে বসতি স্থাপন করায় তা যেমন বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তেমনি জীবিকার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বনভূমির গাছই কেটে পাচার করছে তারা। শরণার্থী ক্যাম্প ও বনাঞ্চলে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বন ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। তারা জ্বালানির চাহিদা মেটাতে বনভূমি ধ্বংস করা ছাড়াও পাহাড় কাটা ও মাটি বিক্রি, অবৈধভাবে কাঠ ও বনজদ্রব্য পাচারে যুক্ত হয়েছে। সঠিক নাম-ঠিকানার অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোহিঙ্গা অপরাধীদের শনাক্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের ছয় হাজার ১৬৪ একর বনভূমিতে বসতি স্থাপনের ফলে দুই হাজার ২৭ একর সৃজিত (সামাজিক বনায়ন) বন এবং চার হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যায়। সৃজিত বনের ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি আড়াইশ’ কোটি টাকারও বেশি। মোট বনজদ্রব্যের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা বসতির কারণে বালুখালী-ঘুমধুম করিডোর দিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে হাতি চলাচলের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়েছে। তাই হাতি ও মানুষের মধ্যে সংঘাত বাড়ছে। ইতিমধ্যে হাতির আক্রমণে ১২ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। ভবিষ্যতে এই সংঘাত আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলার বনভূমি এশিয়ান হাতির বাসস্থান, বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী- এই এলাকায় ৬৩টি এশিয়ান হাতি বাস করে। উখিয়া-টেকনাফ এবং রামু (আংশিক) উপজেলার বনভূমিতে বাস করলেও পানেরছড়া-রাজারকূল এবং বালুখালী-ঘুমধুম করিডোর দিয়ে হাতিগুলো বান্দরবান ও মিয়ানমারে চলাচল করত। রামু ক্যান্টনমেন্ট স্থাপনের ফলে আগেই পানেরছড়া-রাজারকূল করিডোর বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা আসায় বাকি সাড়ে চার কিলোমিটার করিডোরও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হাতির সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষ বাড়ছে। উখিয়া-টেকনাফের বনভূমিতে পরিকল্পনাহীন বসতি এবং জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের ফলে হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে এবং হাতির খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে মানুষ ও হাতির সংঘর্ষ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্যাপক ক্ষতি জীববৈচিত্র্যের :
রোহিঙ্গা বসতির ফলে জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়, যা নিরূপণে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তাছাড়া এই ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করতে হয় বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন সিঙ্গেল পয়েন্ট মোরিং (এসপিএম) প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত সংরক্ষিত বনভূমিতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিশেষজ্ঞ কমিটি জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করে। একই জেলায় প্রায় একই ভূ-প্রকৃতির অংশ হওয়ায় এসপিএম প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির নির্ধারিত ক্ষয়ক্ষতির অনুরূপ হারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে ধ্বংস হওয়া ছয় হাজার একর রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনভূমিতে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। বনজদ্রব্যের ৪৫০ কোটি ও জীববৈচিত্র্যের এক হাজার ৪০৯ কোটি মিলে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।