কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফবাসীর কপাল পুড়েছে রোহিঙ্গায়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তিন বছরের প্রতিক্রিয়ায় এক বাক্যের এ কথাটি মানুষের মুখে মুখে। সাড়ে ৫ লাখ বাসিন্দার এই সীমান্ত জনপদের আগামী প্রজন্ম শিক্ষা-দীক্ষায় ৫০ বছর পিছিয়েছে-এমন উদ্বেগটিই স্থানীয় বাসিন্দাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সীমান্ত জনপদের একজন মেধাবী সন্তান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মতো শীর্ষ স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তার পদ থেকে সাম্প্রতিককালে অবসরে গেছেন। আর সেই জনপদের মানুষগুলোই এখন তাদের সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে মস্তবড় ভাবনায় পড়েছেন।
তদুপরি বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার এক ভিন্ন পরিবেশ এসব শিক্ষার্থীদের টেনে নিচ্ছে এক আলাদা জগতে। ফলে লেখাপড়া লাটে উঠেছে। কক্সবাজারের দক্ষিণ সীমান্ত জনপদের অন্যতম বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উখিয়া ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক অজিত দাশ এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানান, গেলবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১৬৯ জন পাশ করেছে। শতকরা ৩০ জন পাশের হারের কলেজটিতে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট পরবর্তী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আগে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশের হার ছিল এর চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। একমাত্র রোহিঙ্গা এনজিও এলাকার লেখাপড়ায় মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে-বলেন অধ্যাপক অজিত দাশ।
টেকনাফের সাগর পাড়ের শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীরও অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা বাদ দিয়ে ঢুকে পড়েছে এনজিওতে। এমনকি দশম শ্রেণীর একজন ছাত্র পার্শ্বের রোহিঙ্গা শিবিরের এক রোহিঙ্গা কিশোরীর সঙ্গে প্রেমে পড়ে রীতিমত পড়ালেখাও ছেড়ে দিয়েছে। এমনসব চিত্র তুলে ধরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম এ মঞ্জুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরের এনজিওগুলোর টানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্র পর্যন্ত পড়ালেখা বাদ দিয়ে মাসিক বেতন গুণছে। এভাবে টাকার লোভে পড়ে উখিয়া-টেকনাফের শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়েছে ৫০ বছর।’
শিক্ষক এম এ মঞ্জুর আরো বলেন, কেবল উখিয়া-টেকনাফ নয় পুরো কক্সবাজার জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ায় রোহিঙ্গা এনজিও’র নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়ার বাসিন্দা অধ্যাপক আলমগীর মাহমুদ বলেন, একটি জাতির উত্থানের নেপথ্যে বড় সোপান হচ্ছে শিক্ষা। সেই শিক্ষায় এখন পিছনে টান পড়েছে। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে- রোহিঙ্গা।
তিনি বলেন, উখিয়ার মেধাবী সন্তান মোহাম্মদ শফিউল আলম মাত্র কয়েক মাস আগে দেশের শীর্ষ স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ থেকে অবসরে গিয়ে যোগ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকে। রোহিঙ্গার কারণে বর্তমানে লেখাপড়া যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে-এই জনপদে এরকম কোনো মেধাবী সন্তান কবে যে ফিরে আসবে তাই এখন বলা মুশকিল।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী আন্দোলনে ভাটা
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিয়ে এলাকার মানুষ বেশ সোচ্চার ছিল। প্রত্যাবাসন বিরোধী অন্দোলনের ব্যানারে স্থানীয় বাসিন্দারা নানা সময় প্রতিবাদ সমাবেশ-মানববন্ধন কর্মসূচিসহ নানা আন্দোলনও করেছে। কিন্তু এসব অন্দোলন কর্মসূচি এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে গত কয়েক মাসেও কোনো কর্মসূচি পালনের তথ্যও কারো কাছে নেই। এ বিষয়ে এলাকার অনেকেরই মন্তব্য-আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলো অত্যন্ত কৌশুলি ভূমিকা নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে নানা সহায়তার হাত বাড়িয়ে অন্তত: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দাবিতে কিছুটা হলেও নমনীয় করতে পেরেছে।
এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসাবে পরিচিত উখিয়ার বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন-‘রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ এটা যেমনি জানি তেমনি তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনও বিলম্বিত হবে-এটাও আমাদের জানা। তাই প্রতিদিন মাইক নিয়ে রোহিঙ্গা হঠাও বলে চিল্লাচিল্লি করেইবা কি আর লাভ হবে।’ তিনি বলেন, রোহিঙ্গায় এসময়ে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হচ্ছে-প্রশাসন আর এনজিও’র মধ্যে গড়ে উঠা ঐক্য।
নূর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, দেশের আড়াই শ বছরের মূলধারার প্রশাসনিক ব্যবস্থা জেলা প্রশাসনকে বাদ দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) এর আওতায় এনজিও ব্যবস্থাপনার যে কথাটি শুনা যাচ্ছে তা হবে দেশের জন্য বড় ধরনের বিপত্তি। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন যে, রোহিঙ্গা এনজিওগুলো এতদিন ধরেই জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তদারকিতে চলে আসছে।
সম্প্রতি আরআরআরসি অফিস থেকে এনজিও ব্যুরোর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত এনজিওগুলোর তদারকির দায়িত্ব তাদের (আরআরআরসি) কাছে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে বছরে জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজার শিশু
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরে গড়ে বছরে জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজার ৪৩৮ জন শিশু। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনের (ইএনএইচসিআর) পপুলেশন সীট ও শিবিরের হেলথ সেক্টরের তথ্য এটি। এতে আরো বলা হয়েছে গড়ে প্রতি বছর ৩৫ হাজার ৪ জন নারী গর্ভবতী হন। সেই হিসাবে গত তিন বছরে কমপক্ষে এক লাখ শিশু জন্ম গ্রহণ করেছে।
সুত্র: কালেরকণ্ঠ।