বিজিবি চেকপোস্ট থেকে বাহারছরা শামলাপুর এপিবিএন এর চেকপোস্টে মেজর (অবঃ) সিনহা পৌঁছেন ৬ মিনিটে। সেখানে দায়িত্ব পালনরত এপিবিএন এর সদস্যরা মেজর (অবঃ) সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে হাতে ইশারা করে সিনহার গাড়ি ছেড়ে দিতেই প্রায় দু’গজ দূরে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকা ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ‘গাড়ি ছাড়ছ কেন, গাড়ি থামাও’ বলে এপিবিএন এর সদস্যদের নির্দেশ দেন। গাড়ি নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হওয়া সিনহা তখন গাড়ি থামিয়ে ফেলেন। তারমধ্যেই লিয়াকত তার বাম হাতে পিস্তল ও ডান হাতে জোরে ধাক্কা দিয়ে সিনহার গাড়ির সামনে সেখানে আগে থেকেই থাকা একটি ড্রাম ফেলে দেন। তারপর পিস্তলটি হাত বদল করেন। তখন ড্রাম ফেলার বড় একটি আওয়াজ হয়। লিয়াকত গাড়িতে কে জানতে চান, সিনহা তখন আবার নিজের পরিচয় দেন। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে উত্তপ্ত কন্ঠে ইন্সপেক্টর লিয়াকত গাড়ি থেকে সিনহাকে নামতে বলেন। ২০ সেকেন্ড থেকে ২৫ সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়ি স্টার্টে রেখে ‘কাম ডাউন’, ‘ওকে নামছি’, ‘আচ্ছা বাবা নামছি’ বলে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে যান। মেজর (অবঃ) সিনহা অত্যন্ত বিচক্ষণ ও মেধাবী হওয়ায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পরিবেশের ক্ষিপ্রতা বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিনি দু’হাত উঁচু করে নামেন। তখন লিয়াকত মেজর (অবঃ) সিনহা নামটা শুনার সাথে সাথেই দেরি না করে পর পর ৩ টি গুলি ছুড়েন। তাতেই সিনহা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং লিয়াকত তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
মাত্র ৬মিনিট আগে বিজিবি’র শীলখালী চেকপোস্টে বিজিবি’র সদস্যরা যাকে ৪ বার স্যালুট দিলো, তাকেই এপিবিএন এর চেকপোস্টে নাম শুনার সাথে সাথেই গুলি করে হত্যা করা হলো। যিনি বিজিবি’র চেকপোস্টে নিজে গাড়ি থামিয়ে পরিচয় দিয়েছেন, কুশল বিনিময় করেছেন, স্যালুট নিয়েছেন এবং আবার তার বিরুদ্ধেই এপিবিএন এর চেকপোস্টে এসে সিগন্যাল না মেনে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। একাধিক তদন্তকারী সংস্থা এখনো পর্যন্ত যার কোন ভিত্তি পায়নি। বরং অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, সুরতহাল প্রতিবেদন, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, ঘটনার সময়ের সার্বিক পরিস্থিতি সব কিছু পর্যালোচনা করে বলছেন, সিনহাকে করা গুলি ডাকাতদল মনে করে নয়, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আত্মরক্ষার জন্যও নয়, গুলি করা হয়েছিলো সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য। তাই গুলি গুলো সিনহার শরীরে বিভিন্ন দুরত্বে ছুড়া হয়েছে, টার্গেট করেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ তাদের বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে মেজর (অবঃ) সিনহা নিহত হওয়ার পূর্বে তাঁর নিজের পিস্তল ইন্সপেক্টর লিয়াকতের দিকে তাক করার অভিযোগটি সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
ঘটনাস্থলের মাত্র ৮গজ দূর অবস্থিত একটি জামে মসজিদ। জামে মসজিদ সংলগ্ন রয়েছে নুরানী মাদ্রাসা। মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকেরা সবাই মসজিদের চাদের উপরে বসে স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদে কখন ক’টায় ঈদুল আযাহার জামাত অনুষ্ঠিত হবে তার ঘোষনা শুনছিলেন। তারা সহ প্রায় অর্ধ্বশত লোক পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, গুলির শব্দ শুনে সেদিকে থাকিয়ে ঘটনা আবলোকন করেছেন, যারা ঘটনার আংশিক প্রত্যক্ষ্যদর্শী, ঘটনাস্থলের ৯/১০ গজ দূরে একটা বাজার। পরদিন ঈদুল আযাহা হওয়ায় বাজারেও তখন শত শত মানুষ ছিলো। তাদের অনেকেও ঘটনাস্থলের আশপাশ দিয়ে আসা যাওয়া করেছেন। তাদের অনেকেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও আংশিক দেখেছেন। যারা সকলেই ঘটনার উপরোক্ত বর্ননা দিয়েছেন। যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। আবার একই ধরনের ঘটনার বর্ননা দিয়েছেন, মেজর (অবঃ) সিনহা মোঃ রাশেদ খানের গাড়িতে থাকা তাঁর ডকুমেন্টারি ফ্লিম তৈরির টিমের সদস্য সাহেদুর রহমান সিফাত।
অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ ঘটনা প্রবাহ সার্বিক পর্যালোচনা করে মেজর (অবঃ) সিনহা হত্যাকান্ড ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ (!) কিনা তা সন্দেহ করছেন। না হয়, অপরাধ বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন হলো-মেজর (অবঃ) সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে কেন তাকে গুলি করা হলো। মেজর (অবঃ) সিনহাকে কিছু বলতে ও জানতে দেওয়া হলোনা কেন। তখন তো মেজর (অবঃ) সিনহার আচরণ ছিলো বিনয়ী ও নম্র। তারপরও দেড়-দু’মিনিটের ব্যবধানে মেজর অবঃ সিনহাকে হত্যা করা হলো কেন? আর তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আগে থেকে টেকনাফ থানা থেকে রওয়ানা দিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাল কেন?
এদিকে, মাত্র দেড়-দু’মিনিটের ব্যবধানে মেজর অবঃ সিনহা হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ায় প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যায়ন করে পেশাদারিত্বের সাথে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন- র্যাব সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার। তিনি বলেন, সেদিন এমন কি ঘটেছিলো, যার জন্য মাত্র দেড়-দু’মিনিটে মেজর (অবঃ) সিনহাকে হত্যা করতে হলো। সেটাই তদন্ত কর্মকর্তা উদঘাটনের চেষ্টা করছেন। কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার বলেন, এই হত্যাকান্ডের তদন্তে কোন প্রকৃত দোষী যাতে আইনের আওতা থেকে বাদ পড়ে না যায় এবং কোন নিরপরাধী যাতে হয়রানীর শিকার না হয়, সেজন্য সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সাথে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।